রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস

রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস (Rheumatoid Arthritis) এমন একটি রোগ, যেখানে রোগীদের হাঁটু, গোড়ালি, পিঠ, কব্জি বা ঘাড়ের জয়েন্টগুলিতে ব্যথার অনুভূত হয়। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ফলে জয়েন্টে ব্যথা, ফোলাভাব এবং পেশী শক্ত হয়ে যায়। এই রোগটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায়। তবে জীবনযাত্রার পরিবর্তনের জন্য বর্তমানে যুব সমাজও এর শিকার হচ্ছে। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস কেবলমাত্র জয়েন্টে ব্যথার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যদি সময় মতো চিকিৎসা না করা হয়, তবে এটি শরীরের জয়েন্ট ও হাড়ের ক্ষতি করার পাশাপাশি, চোখ, ত্বক, ফুসফুসের মতো অন্যান্য অঙ্গকেও প্রভাবিত করতে পারে।

এটি একটি অটো-ইমিউনো ডিসঅর্ডার যা ইমিউন সিস্টেম শরীরে প্রভাব বিস্তার করার সময় ঘটে, একদিকে অটো-ইমিউনো সিস্টেম শরীরকে যে কোনও ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। কিন্তু অন্যদিকে এই অটো-ইমিউনো ডিজিজ, শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং স্বাস্থ্যকর কোষগুলিকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে শুরু করে। এর ফলে দেহের বিভিন্ন অংশ এবং জয়েন্টগুলি অতিরিক্ত ফুলে যায় ও ব্যথা হয়। যদি ফোলা দীর্ঘক্ষণ ধরে থাকে তবে এটি জয়েন্টগুলিতে ক্ষতির কারণ হতে পারে। যা খুবই বিপদজনক।


এর সাথে জড়িত প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলো হলো:
  • সকালে ঘুম থেকে উঠে আড়ষ্ঠতা যেটা পুরো দিন ক্রমাগত জয়েন্টের নড়াচড়ার ফলে কমে যায়
  • ক্লান্তি
  • অ্যানিমিয়া বা রক্ত কমে যাওয়া
  • জয়েন্টে ব্যাথা
  • শুকনো চোখ এবং মুখ
  • কনুইতে, হাতে, হাঁটুতে এবং অন্যান্য জয়েন্টে শক্ত মাংসপিন্ড
  • জয়েন্টে লালভাব এবং ফোলা
  • বুকে ব্যথা
  • জ্বর ও ওজন কমে যাওয়া

জয়েন্টে ব্যাথা অবস্থাটা হাত ও পায়ে উভয় জায়গাকেই একইসাথে প্রভাবিত করে। এটা ৩০ বছরের পরে যেকোন সময় হতে পারে এবং পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের বেশীই আক্রান্ত করে। কখনো ব্যথা এবং ক্লান্তি প্রদাহের সাথে হঠাৎই ঘটতে পারে এবং অবস্থাটা আরো খারাপ করে তোলে।

যদিও এই অবস্থার পিছনে প্রকৃত কারণ এখনো জানা যায়নি, নিচে উল্লেখিত কারণগুলোকে এই অবস্থার প্রধান কারণ মনে করা হয়:
  • জিনের পরিবর্তন
  • বাবার বংশে কারোর এই ব্যাধি থাকা
  • সংক্রমণ
  • হরমোনের পরিবর্তন
  • মানসিক হতাশা
  • ধূমপান
মূলত উপরোক্ত উপসর্গ দেখে এই রোগ নির্ণয় করা হয়। এছাড়াও, শারীরিক পরীক্ষা, এক্স-রে এবং রক্ত পরীক্ষা যেমন ইএসআর বা সি-রিএক্টিভ প্রোটিন শরীরের প্রদাহের উপস্থিতি নির্দেশ করতে পারে। এই রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি রিউমাটয়েড ফ্যাক্টর এবং এন্টি-সিসিপি অ্যান্টিবডিগুলির উপস্থিতি এই রোগের উপস্থিতি নিশ্চিত করে। চিকিৎসা আরো ফলপ্রসু হয় যদি এই রোগ খুব তাড়াতাড়ি নির্ণয় করা হয় ও এর চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া হয়।

রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস এর চিকিৎসা হলো: প্রদাহজনিত প্রক্রিয়াকে একেবারে কমিয়ে আনা। এর ফলে অস্থিসন্ধির নড়াচড়া সংরক্ষিত হবে, মাংসপেশি সবল ও সুস্থ থাকবে এবং অস্থিসন্ধির শক্ত হওয়া রোধ হবে ও অস্থিসন্ধি বিকলাঙ্গ হওয়া থেকে রক্ষা পাবে। সংশ্লিষ্ট উপসর্গগুলো যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা।কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশনের মাধ্যমে বিকলাঙ্গতা ঠিক করা, ব্যথা নির্মূল করা এবং অস্থিসন্ধি দৃঢ় রাখা।

এর চিকিৎসায় সাধারণ ব্যবস্থা: এটির উদ্দেশ্য হলো রোগীর সাধারণ অবস্থার উন্নয়ন এবং অস্থিসন্ধিকে স্থিতি রাখা। সাধারণ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে, পূর্ণ বিশ্রাম নেয়া। এটা ফোলা, ব্যথা ও অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে।ভালো খাওয়া দাওয়া করা। প্রোটিন ও মিনারেলসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া। রক্তস্বল্পতা থাকলে তা রক্ত পরিসঞ্চালন ও হেমাটিনিকের মাধ্যমে ঠিক করা। অস্থির উন্নয়নে ইস্ট্রোজেন ও অ্যানড্রোজেন হরমোন মিশ্রণ গ্রহণ করা। সংক্রমিত কেন্দ্রবিন্দু অপসারণ করা।

চিকিৎসা প্রি-এক্টিভ এবং রিঅ্যাক্টিভ উভয় ভাবেই করা হয়, তিন ধরনের ওষুধ নিয়মিত ব্যবহার করা হয়:
  • অ্যানালজেসিক বা ব্যথানাশক ওষুধ
  • ডিএমএআরডি বা ডিজিজ-মডিফাইং অ্যান্টি রিউম্যাটিক ড্রাগস
  • অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি বা প্রদাহবিরোধী ওষুধ
ব্যথানাশক ওষুধের মধ্যে রয়েছে: অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রফেন, কিটোপ্রফেন, ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম, ন্যাপ্রোক্সেন, পাইরোক্সিকাম ইত্যাদি।

ডিএমএআরডি জাতীয় ওষুধগুলোর মধ্যে সাধারণত যেগুলো সচরাচর রোগীদের দেয়া হয়: সোডিয়াম অরোথিওম্যালেট- ইনজেকশন আকারে এবং মুখে। এটি বেশি দিন ব্যবহার না করাই ভালো। এছাড়া রয়েছে পেনিসিলামাইন, সালফাস্যালাজিন, ক্লোরোকুইন, ড্যাপসন ও লিভামিসল।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় আদর্শ হলো এনএসএআইডি: এর পূর্ণ অর্থ হলো ননস্টেরয়েড অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগস। একই সাথে এরা ব্যথা এবং প্রদাহ কমায়। সত্যিকার অর্থে আদর্শ এনএসএআইডি বলতে কিছু নেই। তবে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় এনএসএআইডির মধ্যে প্রথম পছন্দনীয় ওষুধটি হলো অ্যাসপিরিন। অবশ্য চিকিৎসকেরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী এনএসএআইডি দিয়ে থাকেন। এনএসএআইডির আদর্শমাত্রা হলো দিনে দু’বার। এক সময়ে একটি মাত্র এনএসএআইডি ব্যবহার করা উচিত। দুই থেকে তিন সপ্তাহ চেষ্টা করা যেতে পারে। আর মনে রাখতে হবে, এনএসএআইডি শুধু রোগের লক্ষণগুলোকে উপশম করে, রোগের প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব ফেলে না। সব এনএসএআইডি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটায়, তাই এই ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শে সাবধানতার সাথে গ্রহণ করা উচিত।

এ ছাড়া স্টেরয়েড, বিশেষ করে অস্থিসন্ধিতে ইনজেকশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ব্যায়াম, ইয়োগা, ফিজিওথেরাপী ব্যথা কমাতে এবং জয়েন্টে আবার গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। বিশ্রাম, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং খাদ্যতালিকায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড যুক্ত করার মাধ্যমে এই রোগের সম্পূরক চিকিৎসা করা হয়।

এমবিবিএস (ঢাকা), এমপিএইচ,
সিসিডি (বারডেম), সিএমইউ

Comments