ডায়াবেটিস মেলাইটাস

সারা বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, বর্তমানে প্রায় ৫৩৭ মিলিয়ন মানুষ, যাদের বয়স ২০-৭৯ বছরের মধ্যে তারা সবাই ডায়াবেটিসে ভুগছেন (তথ্যসূত্র: আইডিএফ ডায়াবেটিস অ্যাটলাস দশম সংস্করণ)। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)-এর এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখ। এদের মধ্যে ১৮-৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২৬ লাখ আর ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা ৮৪ লাখ। প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এই দীর্ঘমেয়াদী রোগে। ২০১৫ সালে ডায়াবেটিসের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন জটিলতায় ৫০ লক্ষ প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ মারা গেছে, যা মোট মৃত্যুর ১৪.৫ শতাংশ। বর্তমান বিশ্বে স্বাস্থ্য বাজেটের ১২ শতাংশ খরচ হয়ে থাকে ডায়াবেটিস চিকিৎসায়। যে সব লোক প্রি-ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থায় রয়েছে তাদের পরবর্তীকালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি ২৫-৩০ শতাংশ।
 
ডায়াবেটিস মেলাইটাস সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা: সাধারণ মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস বিষয়ক প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো-
  • ধনীদেরই ডায়াবেটিস হয়
  • শুধু বয়স্কদের ডায়াবেটিস হয়
  • শহরের লোকদেরই ডায়াবেটিস হয়
  • শুধু মোটা ও শ্রমবিমুখ মানুষদের ডায়াবেটিস হয়
  • বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়
  • শারীরিক মিলনে ডায়াবেটিস হয়
  • ডায়াবেটিস হলে মাটির নিচের খাবার খাওয়া যায় না
  • ডায়াবেটিস হলে খাবার কম খেতে হয়
  • যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করা উচিত নয়
  • যারা ইনসুলিন নিয়ে থাকেন বা ট্যাবলেট খান তাদের খাওয়াদাওয়ায় কোন বাধা নেই
  • টক ও তিতা জাতীয় খাবার ইনসুলিন বা ট্যাবলেটের মতো রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর
  • ইনসুলিন বা ট্যাবলেট বন্ধ করে ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে
  • রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে ইনসুলিন বা ট্যাবলেটের মতোই আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক ওষুধ সমান কার্যকর
  • যাদের ডায়াবেটিস আছে, অন্য কোন অসুখ হলে ডায়াবেটিসের ওষুধ বন্ধ করে দেয়া উচিত
  • একবার ইনসুলিন নিতে শুরু করলে আর ট্যাবলেটে ফেরত আসা যায় না
  • ডায়াবেটিস আক্রান্ত মহিলাদের গর্ভধারণ করা উচিত নয়
  • ডায়াবেটিক মায়ের সন্তান ডায়াবেটিস নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে
  • ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়
ডায়াবেটিস কি?
ডায়াবেটিস সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণাগুলো সঠিক নয়। বাস্তবতা হলো ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ। অগ্ন্যাশয় হতে নিঃসৃত ইনসুলিনের পরিমাণ বা কার্যক্ষমতা কমে গেলে বা এ দুয়ের মিলিত প্রভাবে ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। স্থান, ওজন ও বয়সভেদে যে কেউ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। অবশ্য ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অন্যান্যদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি-
  • যাদের পরিবারে (বিশেষ করে নিকট আত্মীয়ের) ডায়াবেটিস থাকে
  • যারা বেশি বয়সী, মোটা ও শ্রমবিমুখ এবং ক্যালরিবহুল খাবারে অভ্যস্ত
  • বিশেষ কিছু জাতি গোষ্ঠী।
ডায়াবেটিস প্রধানত চার ধরনের: টাইপ-১, টাইপ-২, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও বিশেষ ধরনের ডায়াবেটিস।

যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের সরল শর্করা (বিশেষ করে চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার) ব্যতীত অন্যান্য খাবার পরিমিত খেতে কোন বাধা নেই। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে এবং বিশেষ কোন জটিলতা যেমন হৃদরোগ, কিডনিজনিত রোগ, স্নায়ুরোগ অথবা অতিরিক্ত রক্তচাপ ইত্যাদি না থাকলে ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের শারীরিক শ্রম কিংবা প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলায় অংশ নিতে কোনো বাধা নেই। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকলে ডায়াবেটিক মহিলাদের গর্ভধারণে কোন বাধা নেই। এমনকি গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রেখে গর্ভস্থ শিশু ও মায়ের গর্ভকালীন জটিলতাও কমানো যায়।

ইনসুলিন শরীরের অগ্ন্যাশয় নামক একটি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন যা রক্তনালী থেকে গ্লুকোজকে দেহকোষে প্রবেশে সাহায্য করে থাকে, দেহকোষের বা শরীরের সকল কাজের জন্য এই গ্লুকোজ প্রয়োজন। টাইপ-১ ডায়াবেটিস এ ইনসুলিনই একমাত্র চিকিৎসা, এছাড়া অন্যান্য ধরণের ডায়াবেটিসে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হতে পারে। আধুনিক ইনসুলিনগুলিতে যেমন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কম তেমনি দেবার পদ্ধতিও সহজ। এগুলোতে ইনজেকশন জনিত ব্যথা একদম নেই বললেই চলে। ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। এ কারণে ডায়াবেটিক ব্যক্তিকে আজীবন গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখার বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। আশার বাণী হলো ডায়াবেটিসে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে এবং প্রয়োজনে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।

ডায়াবেটিস এর ঝুঁকিসমূহ
  • পরিবর্তনযোগ্য নয় এমন ঝুঁকিসমূহ হচ্ছে: বয়স বেশি হলে, যাদের বংশে বিশেষ করে, বাবা-মা, ভাই-বোনের ডায়াবেটিস আছে ।
  • পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকিসমূহ হচ্ছে: যাদের ওজন স্বাভাবিকের থেকে বেশি, যারা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করেন না, যারা অতিমাত্রায় ফাস্টফুড খান বা কোমল পানীয় পান করেন, মহিলাদের মধ্যে যাদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ছিল, যাদের প্রি-ডায়াবেটিস আছে।
ডায়াবেটিস এর উপসর্গসমূহ
  • ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, ঘন ঘন পিপাসা পাওয়া, ঘন ঘন ক্ষুধা লাগা, ওজন কমে যাওয়া, শারীরিক দুর্বলতা।
  • ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ নাও থাকতে পারে।
ডায়াবেটিস সনাক্তকরণ পরীক্ষা
  • খালি পেটে রক্ত পরীক্ষা
  • র‌্যান্ডম রক্ত পরীক্ষা
  • ওজিটিটি পরীক্ষা (একমাত্র এই পরীক্ষার মাধ্যমে গ্লুকোজের মাত্রা এবং ডায়াবেটিস ও প্রি-ডায়াবেটিস সনাক্ত করা যায়, এজন্য প্রথমে সকালে খালি পেটে রক্ত পরীক্ষা করা হয়, যা হতে হবে রাতের খাবারের ৮-১৪ ঘন্টার মধ্যে এবং ২য় বার ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ ২৫০-৩০০ মিলিলিটার পানিতে গুলিয়ে খাবার ২ ঘন্টা পর রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করা হয়।)
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে করণীয়
  • ডায়াবেটিস হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করুন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন অর্থাৎ সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে ৬০ শতাংশ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা যায়।
  • পরিমিত সুষম খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন, ক্রটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসই পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ অসুখের মূল কারণ। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ শাক–সব্জি, ফলমূল এবং পরিমিত পরিমান শর্করা ও আমিষ খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। সেই সাথে বর্জন করতে হবে ক্যালরীবহুল ও চর্বিযুক্ত খাবার, ফাস্ট ফুড, কোমল পানীয় এবং চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার।
  • প্রতিদিন নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রমের অভ্যাস করুন। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে প্রতিদিন দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ১৫০ মিনিট দ্রুতগতিতে হাঁটতে হবে।
  • ওজন স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যে রাখুন, প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ শাক–সব্জি, ফলমূল খাবার পাশাপাশি শিম, আঁশযুক্ত, শস্যজাতীয় এবং বাদামজাতীয় খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। সেই সাথে বর্জন করতে হবে চর্বিযুক্ত, চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার। ওজনাধিক্য ও স্থুলতা প্রতিরোধে দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি শিশু–কিশোরদের প্রতিদিন ৬০ মিনিট ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের সপ্তাহে ১৫০ মিনিট দ্রুতগতিতে হাঁটতে হবে।
  • ডায়াবেটিস আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখুন, ৫০ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিই জানেন না তার ডায়াবেটিস আছে। ওজিটিটি পরীক্ষায় যদি খালি পেটে রক্তের গ্লুকোজ ৭.০ মিলিমোল/লি এর সমান বা বেশী হয় এবং/ অথবা গ্লুকোজের শরবত খাওয়ানোর ২ ঘন্টা পর ১১.১ মিলিমোল/লি এর সমান বা বেশী হয় তাহলে ডায়াবেটিস হয়েছে ধরতে হবে।
  • গর্ভধারণের পূর্বে ও গর্ভকালীন সময়ে ডায়াবেটিস আছে কিনা পরীক্ষা করুন, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের পরবর্তীকালে টাইপ–২ ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি থাকে। ওজিটিটি পরীক্ষায় যদি খালি পেটে রক্তের গ্লুকোজ ৫.১ মিলিমোল/লি এর সমান বা বেশী হয় এবং/ অথবা গ্লুকোজের শরবত খাওয়ানোর ২ ঘন্টা পর ৮.৫ মিলিমোল/লি এর সমান বা বেশী হয় তাহলে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়েছে ধরতে হবে। গর্ভধারণ–পূর্ব সেবা গ্রহণের মাধ্যমে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ও পরবর্তীকালে টাইপ–২ ডায়াবেটিস এর পাশাপাশি অন্যান্য অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই গর্ভধারণে সক্ষম সকল নারীর (১৮ থেকে ৪৫ বছর) অতি দ্রুত গর্ভধারণ–পূর্ব সেবা গ্রহণের মাধ্যমে তার শারীরিক ঝুঁকিগুলো জেনে নেয়া উচিত।
ডায়াবেটিস হলে করণীয়
  • ডায়াবেটিসে পক্ষাঘাতের (স্ট্রোক) ঝুঁকি ৬ গুণ, হৃদরোগের ঝুঁকি ২–৩ গুণ, অন্ধত্বের ঝুঁকি ২৫ গুণ, কিডনি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি ৫ গুণ এবং পা কেটে ফেলার ঝুঁকি ২০ গুণ বৃদ্ধি পায়। হিমোগ্লোবিন এ১সি ১% কমাতে পারলে ডায়াবেটিসজনিত মৃত্যু ২১%, ছোট রক্তনালীর (মাইক্রোভ্যাসকুলার) জটিলতা ৩৭% এবং বড় রক্তনালীর (ম্যাক্রোভ্যাসকুলার) জটিলতা ১৪% কমে যায়।
  • ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা খালি পেটে/ খাবার আগে ৭ মিলিমোল/লি এর নিচে, খাবার ২ ঘন্টা পর ১০.০ মিলিমোল/লি এর নিচে এবং হিমোগ্লোবিন এ১সি ৭% এর নিচে রাখতে হবে।
  • গর্ভকালীন সময় সকল রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা খালি পেটে/ খাবার আগে ৫.৩ মিলিমোল/লি এর নীচে এবং খাবার ২ ঘন্টা পর ৬.৭ মিলিমোল/লি এর নীচে রাখতে হবে।
  • ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা, ওজন ও রক্তচাপ মেপে দেখার পাশাপাশি বছরে কমপক্ষে একবার চোখ, দাঁত, পা, হার্ট, কিডনি, লিভার এবং রক্তে চর্বির মাত্রা চিকিৎসকের পরামর্শমতো পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
  • ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তচাপ ১৩০/৮০ এর নিচে, কোলেস্টরলের মাত্রা ২০০ মিলিগ্রাম/ডিএল এর নিচে, ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা ১৫০ মিলিগ্রাম/ডিএল এর নিচে, এলডিএল এর মাত্রা ১০০ মিলিগ্রাম/ডিএল এর নিচে, এইচডিএল এর মাত্রা পুরুষদের ক্ষেত্রে ৪০ মিলিগ্রাম/ডিএল এর উপরে ও মহিলাদের ক্ষেত্রে ৫০ মিলিগ্রাম/ডিএল এর উপরে রাখতে হবে।
  • ধুমপানের অভ্যাস অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
এমবিবিএস (ঢাকা), এমপিএইচ,
সিসিডি (বারডেম), সিএমইউ

Comments