সাপে কাটা: বিষাক্ত সাপের কামড় থেকে বাঁচতে করণীয়, সাপে কাটলে কি করবেন

সাপকে ভয় পান না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, আর সাপে কাটলে তো কথাই নেই। তবে বিশ্বে যত সাপ আছে তাদের বেশিরভাগই বিষহীন, বিষযুক্ত সাপের সংখ্যা কম। সারা বিশ্বে প্রতি বছর সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা ৮১ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজারের মধ্যে। আর বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর সাপে কাটার শিকার হয় আনুমানিক ৪৫ লাখ মানুষ। সঠিক সংখ্যা জানা না থাকলেও আমাদের দেশে সাপে কাটার হার কম নয়, সাধারণত গ্রামে বেশি সাপে কাটে। সাপে কাটাকে এখন বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে উপেক্ষিত একটি স্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে - যে সমস্যা বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সাপে কাটা একটি অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ও একটি জরুরী স্বাস্থ্য সমস্যা। সাপে কাটা ব্যক্তি এ রকম পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত থাকেন না। বিষধর সাপের আঘাতে মৃত্যুও হতে পারে। সাপে কাটা ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে অবৈজ্ঞানিক ভ্রান্ত ধারনা প্রচলিত রয়েছে।

সাপ ও সাপে কাটা নিয়ে প্রচলিত ধারণা:

  • সাপ হিংস্র প্রাণী, সাপ তেড়ে এসে ছোবল দেয়
  • সাপে কাটার পর আক্রান্ত অঙ্গে গিট দিতে হবে
  • সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় আইসিইউ প্রয়োজন
  • বাংলাদেশের উপজেলা হাসপাতালগুলিতে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা সম্ভব নয়
  • সাপে কাটা রোগীকে ১০০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করতে হবে
  • চন্দ্রবোরা বা রাসেলস্ ভাইপার বাংলাদেশের নতুন সাপ
  • রাসেলস্ ভাইপার সর্পদংশনের বেশীর ভাগ রোগী মারা যান
  • রাসেলস্ ভাইপার দংশনের চিকিৎসায় এন্টিভেনম নেই বা কার্যকর নয় এবং এর অনেক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে।
রাসেলস্ ভাইপারের সাম্প্রতিক সময়ে জেলাভিত্তিক বিস্তার

সাপ দেখলে কি করবেন:

  • অযথা ভয় পাবেন না, সাপটিকে চলে যেতে দিন।
  • সাপ স্বেচ্ছায় মানুষকে আঘাত করে না সুযোগ দিলে সাপ সরে যাবে। কেবলমাত্র আত্মরক্ষায় কিংবা উত্যক্ত করলে সাপ মানুষকে ছোবল মারে; কাজেই সাপের কাছে না ঘেঁষা বাঞ্চনীয়।
  • অনাবশ্যক সাপ মারবেন না, কারণ সাপ কীটপতঙ্গ ও ছোট ছোট প্রাণীদের নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষের উপকার করে ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।

সাপে কাটা রোগীর জরুরী প্রয়োজনীয় প্রাথমিক চিকিৎসাগুলি হলো:

  • আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। সাপে কাটা রোগীকে আশ্বস্ত করতে হবে, বেশীরভাগ সাপ অবিষধর। ভয়ের কোন কারণ নেই, সাপে কাটার বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে।
  • সাপে কাটা স্থান (হাত কিংবা পা) অচল করতে হবে। পায়ে সাপে কাটলে বসে যেতে হবে হাঁটা যাবে না, হাতে কাটলে হাত নাড়াচাড়া করা যাবে না। সাপে কাটা রোগীকে পূর্নবিশ্রামে রাখতে হবে।
  • যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সাপে কাটা অঙ্গ থেকে আংটি, চুড়ি, তাবিজ, 'তাগা' খুলে ফেলতে হবে। কারণ পরবর্তীতে ফুলে গেলে এগুলো খুলতে অসুবিধা হবে।
  • সাপে কাটা অঙ্গের হাড় ভেঙ্গে গেলে যেভাবে স্প্লিন্ট এর সাহায্যে নড়াচড়া প্রতিরোধ করা হয় তেমনভাবে রাখতে হবে। হাতের কাছে যদি ক্রেপ ব্যান্ডেজ থাকে তাহলে তাই ব্যবহার করতে হবে। সাপে কাটা হাত-পা এমনভাবে কাপড় ও কাঠ (বা বাঁশের কঞ্চি) দিয়ে পেঁচিয়ে নিতে হবে, যাতে গিড়া নড়াচড়া করা না যায়। গিড়া নাড়াচড়ায় মাংসপেশীর সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। দংশিত স্থান নিষ্ক্রিয় করার জন্য আদর্শ পদ্ধতিতে চাপ (Pressure Immobilization) প্রদান করতে হবে।
  • সাপে কাটা স্থানে রক্তক্ষরণ হতে থাকলে চাপ দিয়ে ধরে রাখা।
  • সাপে কাটা রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠাতে হবে, প্রয়োজনে মটরবাইক/গাড়ী/এ্যাম্বুলেন্সের সাহায্য নিতে হবে।
  • সাপে কাটা রোগীকে একপাশে কাত করে রাখতে হবে।
  • রোগীর যদি শ্বাস-প্রশ্বাস না থাকে, তাহলে মুখে বায়ু ঢোকার নল (oral airway) ব্যবহার করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস সঞ্চালনের ব্যবস্থা করতে হবে।
  • কেউ যদি সাপ মারতে পারে বা ছবি তুলতে পারে, হাসপাতালে যাওয়ার সময় সনাক্তকরণের জন্য তা নিয়ে যেতে হবে। সাপ মারার জন্য কিংবা ধরার জন্য অযথা সময় নষ্ট করা যাবে না। কখনোই খালি হাতে সাপ ধরতে যাবেন না।

বিষধর সাপে কাটার লক্ষণ সমূহ:

  • একেবারে কোন প্রভাব না থাকা (asymptomatic)
  • সাপে কাটা স্থান দ্রুত ফুলে যাওয়া, ফোস্কা পড়া, চামড়ার রং পরিবর্তন, কালচে হওয়া, ব্যথা, পচে যাওয়া, ক্রমাগত রক্তপাত
  • ঘুম ঘুম ভাব, চোখের উপরের পাতা ভারী হওয়া বা বুজে আসা
  • চক্ষু গোলক নড়াচড়া করতে না পারা, ঝাপসা দেখা বা একটি জিনিসকে দুটো দেখা
  • জিহ্বা জড়িয়ে আসা, কথা বলতে অসুবিধা হওয়া
  • ঢোক গিলতে অসুবিধা, খাওয়ার সময় নাক দিয়ে পানি আসা
  • হাঁটতে অসুবিধা হওয়া, হাত পা অবশ হয়ে যাওয়া, ঘাড় দুর্বল হয়ে যাওয়া
  • শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা হয়ে রোগী নীল বর্ণ হয়ে যাওয়া
  • প্রস্রাব কমে যাওয়া, কাল রং এর প্রস্রাব হওয়া 
  • এই সমস্ত ক্ষেত্রে সাপে কাটা রোগীকে অত্যন্ত দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সাপে কাটার পর যা করা উচিৎ নয়:
  • সাপে কাটা অঙ্গে কোন রকম গিট (tourniquets) দেওয়া যাবে না। সাপে কাটা স্থানে কাটবেন না, সুই ফুটাবেন না, কিংবা কোন রকম প্রলেপ লাগাবেন না।
  • সাপে কাটা স্থানে রাসায়নিক পদার্থ, এ্যালকোহল জাতীয় কিছু দেয়া যাবে না; কোনভাবেই- হারবাল ঔষধ, পাথর, বীজ, মুখের লালা, পটাশিয়াম, কাদা, গোবর ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না।
  • হাসপাতালে নেওয়ার পথে রোগীর কথা বলতে অসুবিধা হলে, নাকে কথা বললে কিংবা মুখ থেকে লালা ঝরলে রোগীকে কিছু খেতে দিবেন না। তেল, ঘি, মরিচ, গাছ-গাছালীর রস ইত্যাদি খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা করা যাবে না।
  • ব্যথা উপশম করার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ঔষধ দেয়া যাবে না।
  • ওঝা বা বৈদ্য দিয়ে চিকিৎসা করে কিংবা ঝাড়-ফুঁক করে অযথা সময় নষ্ট করবেন না।
  • স্বাস্থ্য সুবিধা নিতে নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছাতে বিলম্ব করবেন না।
এমবিবিএস (ঢাকা), এমপিএইচ,
সিসিডি (বারডেম), সিএমইউ

Comments