স্বেচ্ছায় রক্তদান সর্বোৎকৃষ্ট সেবা
নিজের জীবনের একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি মেডিকেলে কলেজে যখন আমি এমবিবিএস ১ম বর্ষের ছাত্র, তখন আমার এক ব্যাচমেটের বাবার লিভার সিরোসিসে মুমূর্ষু অবস্থা আর আংকেলের জন্য আমার ব্যাচমেটরা রক্ত খুঁজতে খুঁজতে পাগলপ্রায়। আমার রক্তের গ্রুপের সাথে আংকেলের রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়ায় তখন সবাই আমাকে রক্ত দিতে বলে কিন্তু আগে কখনো রক্ত না দেওয়ায় সাহস করে উঠতে পারিনি। পরে অবশ্য রক্ত যোগাড় হয়েছিল কিন্তু কিছুদিন পরেই আংকেল আমাদের ছেড়ে চলে যান। এই ঘটনার পর আমি কয়েক রাত ঘুমাতে পারিনি এই কথা ভেবে, এরপর থেকেই আমার রক্ত দেওয়া শুরু। এখন তো প্রতি তিন মাস পর পর রক্ত না দিলে নিজের কাছেই খারাপ লাগা শুরু করে কিন্তু এখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি ওই ঘটনার জন্য।
এমনিভাবে যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাচ্ছেন তাদের সহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করতে প্রতিবছরের মত এবারো ১৪ই জুন সারাদেশে পালন হয়েছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস।
১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’-এই থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে প্রথম পালিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক রক্তদাতা দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতিবছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে। ১৪ই জুন তারিখটি বেছে নেয়া হয়েছে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার জন্মদিন হিসেবে, যিনি আবিষ্কার করেছিলেন রক্তের গ্রুপ এ, বি, ও, এবি।
এ বছরের স্লোগান ছিল, 20 years of celebrating giving: thank you blood donors!
দুঃখজনক হলেও সত্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা World Health Organization (WHO) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর ৯২ মিলিয়ন মানুষ রক্ত দান করে থাকে। বিশ্বের ৬২টি দেশে শতভাগ প্রয়োজনীয় রক্ত সংগ্রহ করা হয়ে থাকে এবং বিনামূল্যে রোগীকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টার্গেট ছিল ২০২০ সালের মধ্যে পৃথিবীর কোনো রোগীকে যেন আর টাকা দিয়ে রক্ত কিনতে না হয় এবং যথাসময়ে রক্তের সরবরাহের শতভাগ নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এই ২০২৩ সালেও সেটা সম্ভবপর হয়নি, শুনে অবাক হবেন WHO এর তথ্য অনুসারে আমেরিকার মতো উন্নত দেশে প্রতি দু সেকেন্ডে এক ব্যাগ রক্তের দরকার হয়। আমাদের দেশের সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই। শুধু এটুকু জানি প্রতি মুহুর্তে কেউ না কেউ এক ব্যাগ রক্তের প্রতীক্ষায় হাসপাতালে কোনো এক মানব দেবতার পথ চেয়ে বসে আছে।
হ্যাঁ আপনিই হতে পারেন সেই মানব দেবতা আর নিয়মিত রক্তদানে বিনা খরচেই জানতে পারবেন আপনার হার্টবিট সঠিক গতিতে চলছে কি না, শ্বাসপ্রশ্বাস সঠিকভাবে চলছে কি না। এমনকি এইডস, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, হেপাটাইটিস বি এবং সি তে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি আছে কি না জানতে পারবেন। ইদানীংকালে গবেষণা করে জানা গেছে, যারা ধূমপান করে না তারা যদি নিয়মিত রক্তদান করে তাহলে তাদের হার্ট এটাকের ঝুঁকি কমে যায়। আর যারা শরীরের অতিরিক্ত ওজন ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছেন তাদের জন্য বলছি, এক ব্যাগ রক্ত ৬০০ ক্যালরি খাদ্য মানের সমান। শরীরকে হালকা পাতলা করার জন্য লাভই হবে আপনার যদি এক ব্যাগ রক্ত দান করেন।
এবার দেখে নেওয়া যাক রক্তদান সম্পর্কিত কিছু সরল বাক্যঃ
২। ওজন হতে হবে পুরুষ ও নারীর জন্য কমপক্ষে গড়ে ৪৭ কেজি এবং শারীরিক ফিটনেস ভাল থাকতে হবে
৩। রক্তচাপ ১২০/৮০ থেকে ১৩০/৯০ মি.মি. পারদ চাপ
৪। রক্ত দিতে শরীরে সূচ ঢুকানোর সময় কয়েক সেকেন্ডের জন্য সামান্য ব্যাথা লাগে, এরপর রক্তদানের পুরো প্রক্রিয়ায় কোনোরুপ সমস্যা হয়না
৫। রক্ত দিলে এইডস সহ অন্যান্য কোন জীবানু শরীরে ঢোকার সম্ভাবনা একেবারেই নেই, কারন প্রতিবার রক্ত সংগ্রহের সময় একেবারে নতুন সূচ, ব্যাগ, টিউব ব্যবহার হয় এবং শুধুমাত্র একবারই ব্যবহার করা হয়
৬। একজন মানুষের শরীরে মোট ওজনের শতকরা আট ভাগ সেক্ষেত্রে প্রায় ৫-৬ লিটার রক্ত থাকে আর রক্ত দিতে হয় মাত্র ৪৫০ মিলি লিটার, এই পরিমাণ রক্ত দিলেও শরীরে প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত ৭০০ মিলি লিটার এর মত রক্ত থাকে
৭। আপনি যে রক্ত দিলেন তা এক ঘন্টার মধ্যেই শরীর পূর্ণ করে নিবে, তবে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হতে মোট ৩-৪ মাস সময় লাগবে
৮। সাধারনত ৯০ দিন পর পর আপনি রক্ত দিতে পারবেন
৯। রক্ত দেয়ার আগে নিয়মিত স্বাস্থ্যসম্মত এবং প্রচুর পানি জাতীয় খাবার খেতে হবে
১০। রক্ত দিতে ১০-১২ মিনিট সময় লাগে
১১। রক্ত দেয়ার পর সাধারণত আপনি স্বাভাবিক থাকবেন এবং কিছুক্ষন বিশ্রাম নিতে হয়, যদি খারাপ লাগে সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
আপনার করনীয়ঃ
১) আজকেই আপনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিন, এক ব্যাগ রক্ত দান করবেন এবং এটা হবে আপনার জীবনের সর্বোত্তম, নিঃস্বার্থ, সবচেয়ে সুন্দরতম দান
২) নিজে রক্ত দান করুন এবং আপনার বন্ধুকেও বলুন
৩) চিকিৎসা সেবার সাথে জড়িত না হলেও আপনি যত পারেন স্বেচায় রক্তদান কর্মসূচীর প্রচার করুন।
এবার দেখা যাক দেশে কিছু ব্লাড ব্যাংকের যোগাযোগের ফোন নংঃ
- সন্ধানী ব্লাড ব্যাংক
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখা: ০২-৯৬৬৮৬৯০, ৮৬১৬৭৪৪, ০১৮১৯-২৮৪৮৭৮
ঢাকা ডেন্টাল কলেজ শাখা: ০২-৯০১১৮৮৭, ৮০১৭১৪৬, ৯০০২০৩৫
বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ শাখা: ০২-৯১২৪৬১৯, ৯১১৮২০২; এক্স: ৪৩০
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ শাখা: ০২-৭৩১৯১২৩, ৯৬৬৮৬৯০, ০১৮১৯-২৮৪৮৭৮
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ শাখা: ০৯১-৫৪৮২৯
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখা: ০৩১-৬১৬৬২৫
রংপুর মেডিকেল কলেজ শাখা: ০৫২১-৬২১৮০, ০১৬০১-২৩১৯৮২
বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ: ৬৪৪-৫১০০২৯৫
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ শাখা: ০৫৩১-৪৭৪৮
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখা: ০৭২১-৫২১৬৫১৮০, ০১৭২১-৭৭৩০৮০
খুলনা মেডিকেল কলেজ শাখা: ০৪১-৭৬১৫০৯
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টিএসসি শাখা: ০২-৫৮৬১২৫৪৫, ০১৫৩৪-৯৮২৬৭৪
বুয়েট শাখা: ০১৯১২-০৮২৯১৯
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা: ০১৭১২-১৮০২৪৬
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ শাখা: ০৫৩১-৪৭৪৮
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখা: ০৭২১-৫২১৬৫১৮০, ০১৭২১-৭৭৩০৮০
খুলনা মেডিকেল কলেজ শাখা: ০৪১-৭৬১৫০৯
সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ শাখা: ০৮২১-৭১০৮৮০
- বাঁধন ব্লাড ব্যাংক
বুয়েট শাখা: ০১৯১২-০৮২৯১৯
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা: ০১৭১২-১৮০২৪৬
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা: ০১৫৩৪-৯৮২৬৭৪
- আলিফ ব্লাড ব্যাংক এন্ড ট্রান্সফিউশন সেন্টার: ০১৭১২-৩৯২৯২৩, ০১৯১৩-০৫৯৩৭৫
- রেটিনা ব্লাড ব্যাংক: ০২-৯৬৬৩৮৫৩, ০১৬১৪-৬০৬৪১১
- পুলিশ ব্লাড ব্যাংক: ০২-৯৩৬২৫৭৩, ০১৭১৩-৩৯৮৩৮৬
- রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংক: ০২-৯১১৬৫৬৩, ৮১২১৪৯৭, ৯১৩৯৯৪০
- বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন: ০২-৮৩৩২৪৮১
- বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি: ০২-৯৬৬২২৩৯, ০১৯১২৫৩০৪৯৮
- সন্ধানী ইন্টারন্যাশনাল আই ব্যাংক: ০২-৯১২৪৩৫৩, ০১১৯০-১৫১৪৮০
- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল: ০২-৭৩১৯১২৩
- ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ব্লাড ব্যাংক: ০২-৮৩১৭০৯০, ৮৩২১৪৯৫
- কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন: ০২-৯৩৫১৯৬৯, ০১৭১৪-০১০৮৬৯
- সন্ধানী ন্যাশনাল আই ডোনেশন সোসাইটি: ০২-৮৬১৪০৪০
- চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ: ০৩১-৯৪৬১৬১৯৯, ৬১৬৮৯১-৯৪
- ফাতেমা বেগম রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড সেন্টার, চট্টগ্রাম: ০৩১-৬২০৬৮৫, ৬১২৩৯৫, ৬২০৯২৬
- পোর্ট হাসপাতাল, চট্টগ্রাম: ০৩১-৫০২০২৪
- রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম: ০৩১-৭২০১২১-৩৯
- বেগম তোয়েবা মজুমদার রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড সেন্টার, দিনাজপুর: ০৫৩১-৬৪০২১
- ব্লাড ব্যাংক, খুলনা: ০৪১-৭৬২০০৬
এছাড়া জরুরী রোগীদের রক্তের প্রয়োজনে নিচের লিংক থেকে ডোনারের তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন এবং যোগাযোগ করতে পারেনঃ
Comments
Post a Comment